Adcash

ভবঘুরের রাজ্যদর্শন ৪

 'ভবঘুরের রাজ্যদর্শন'

'কেউ কেউ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকে'





টুং-টুং, টাং-টাং, টুং-টুং, টাং-টাং এ্যালার্ম বাজল। চোখ মেলতেই দেখি সাতটা বিশ। ইয়া আল্লাহ, আমার উঠার কথা ছিলো ছয়টায়, কিন্তু এখন তো বাজে সাতটা বিশ! দশ মিনিটেই হুটহাট দাঁতমেজে, হাত-মুখ ধোয়ে, সৌচ-টৌচ সব সেরে ব্যাগ কাঁধে তুলে হাটঁতে হাঁটতেই বললাম, 'আমি গেলাম'। আমি দৌড়ের উপর থাকি। অবশ্য ব্যাগ-ট্যাগ গুছানো, কোথায় যাবো এসব বলা-কওয়া সব রাতেই শেষ করে ফেলি। জানি, এ যুগের মানুষদের সূর্যের প্রখর রোধ ছাড়া ঘুম ভাঙ্গে না। সকালের হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন উষ্ণ হাওয়া, সূর্যোদয়, গাছের পাতা থেকে টপ-টপ করে কুয়াশা বিন্দু পড়া, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে দলবেঁধে নীড় ছেড়ে উড়ে চলা, গাছের চিকুর পাতার ফাঁকে সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মিটা, মক্তব থেকে ভেসে আসা কুরআনের ধ্বনি ইত্যাদি এ যুগের মানুষদের মনে দাগ কাটতে পারে না, তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমাদের এই ভার্চুয়াল জগত। এজন্যই মানুষ সবচেয়ে বেশি হতাশা, স্বপ্নভঙ্গ, আশাভঙ্গে ভুগছে আজ-কাল। 


মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলার কথা! বিল-হাওর, বনে-বাদাড়ে ইচ্ছেমতো ঘুরাঘুরি করতাম। সকালটা হলেই মক্তবে না গিয়ে সবগুলা হারামি বন্ধুদের ডেকে এনে চারা খেলা, মার্বেল খেলা, কাঠি খেলা, কৌট খেলা (দাড়িয়াবান্ধা খেলা), শুরু করতাম। আম্মা হাতে একটা বেত নিয়ে দৌড়িয়ে ঘরে নিয়ে আগে ইচ্ছেমতো ধুলাই করতেন। তারপর ভাত বেড়ে দিতেন। কান্না মুখেই ভাত খেয়ে হাতে কয়েকটা বই-খাতা আর একটা কলম লয়ে দৌড়ে সোজা মাদরাসায় চলে আসতাম। 


মাদ্রাসায় এসে সামনের ব্যাঞ্চেরগুলোর বসার নিচে চক দিয়ে অনেকগুলা ডিম একে দিতাম৷ ও বসলেই পিছন থেকে জোরে জোরে হাসি-তামাশা করতাম 'ডিম পাড়ছে, ডিম পাড়ছে' বলে। হাতের লেখা না আনার জন্য, স্যারের পড়া না পড়ার জন্য কতো পিটুনি খেতাম। বাড়ি পাশে ছিলো। একটু সময় পেলেই দৌড়ে গিয়ে আম্মাকে বলতাম, "আম্মা বরাক (আইসক্রিম) খামু, টেহা দেন দুইডা।" অনেকক্ষণ গ্যান-গ্যান করার পর এক টাকার হলুদ পয়সা হাতে ধরিয়ে দিতেন। দৌড়ে বরাকের পিডির ( গ্রামে যেটাতে করে আইসক্রিম বিক্রি করে ) কাছে চলে আসতাম। বরাকওয়ালা বলত, "এই হরিণের কস্তরী, খাইলেই ঠান্ডা, একটাতেই চাঙ্গা। মাত্র এক কাটায় পাওয়া যায় সাদা-লাল-নীল-হলুদ বরাক।" আরো নানান রস-ঢঙের কথা শুনা যেতো তাদের মুখ থেকে। সেগারিন দেয়া লাল-লাল বরাকে ভালো করে লবন মেরে জিহ্বা, ঠোঁট, মুখ লাল করে ক্লাসের পিছন দিয়ে ঠুস করে বসে পড়তাম। একজন হুজুর ছিলো, মূসা হুজুর। ওনার জন্য বছরের প্রথম দিকে একটা চার লাইনের পড়া শিখেছিলাম, সেটা দিয়েই সারা বছর কাটিয়ে দিতাম। হুজুর এসে চেয়ারে ঘুমুতেন আর দূর থেকেই পড়া শুনতেন। অবশ্য পড়া শুনতেন না, একটু পরপর মুখ নড়ছে কিনা দেখতেন। মুখ নাড়ানো দেখে দেখে 'বেশ-বেশ' বলে বসে পড়তে বলতেন। স্যার-হুজুর আসতে একটু দেড়ি হলেই টেবিলে শুরু করে দিতাম 'কলম খেলা'। টেবিল থেকে কার কলম কে টোকাতে-টোকাতে ফেলতে পারে। যদিও ম্যাটাডের হাইস্কুল দিয়ে সবসময় লিখতাম, আজও লিখি। কিন্তু টোকাটুকি খেলার জন্য পিনপয়েন্ট রাখতাম পকেটে। না থাকলে কারো কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে আসতাম। যাকে হারাতে পারতাম তার কলম দেয়ালে ঠাসঠাস ভেঙে দিতাম। একটা বাজলে ঘণ্টা বাজাতে দেড়ি হলেও বই-খাতা মাথায় নিয়ে দৌড়ে ক্লাস থেকে বের হতে একটুও দেড়ি হতো না। বইপত্র ঘরে রেখেই হাফপ্যান্ট মাথায় নিয়ে দৌড়ে নদীতে। নদীর পাড় পিচ্ছিল করে হেঁচড় খেতাম, সাঁকো থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে পানিতে পড়তাম, একটা কাটা পাইপ নিয়ে পাড়ে টিউবওয়েল বানাতাম, পাড় বাঁধ দিয়ে পানি সেঁচে মাছ ধরতাম, কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি খেলতাম, আরো কতো কী! চোখ গোলা মরিচের মতো লাল করে শরীরে শ্যাওলা ফেলে বাড়িতে ফিরে যখন দুপুরের ভাত খেতে বসতাম আম্মা ঠিকই বুঝে যেতে ডুবিয়ে-চুবিয়ে এসেছি একেবারে। হাতের উপর দিয়ে সাদা-সাদা কী বের হচ্ছে, চোখ লাল, মাথা থেকে পানি ঝরছে। কোনো রকম খেয়ে দৌড়ে পালাতাম। নয়তো আম্মা আগেই বলে রাখতেম ভাইয়ের সাথে বাজারে যেতে হবে, তাই বাজারে যেতাম। তবে দুই টাকা বরাদ্দ থাকতেই হবে। সেটা দিয়ে লজেন্সের কাগজ কিনতাম চারা খেলার জন্য। আসর হলেই ফুটবল, হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, টেম-ডাং, নাকে খত দেওয়ানো, কুমির খেলা, টায়ার দৌঁড়ানো, রিং গাড়ি দৌঁড়ানো, বিয়ারিং গাড়ি দৌঁড়ানো ইত্যাদি আরো নানান খেলায় বিকাল কাটিয়ে দিতাম। ছিপ হাতে মাছ ধরতাম, জাল দিয়ে মাছ ধরতাম, কোদাল-বোল-জাল নিয়ে হাওরে-বিলে বাঁধ বেঁধে পানি সেঁচে মাছ ধরার জন্য চলে যেতাম। চাদনী রাত হলে  মুরগীর ঝুকনি দিয়ে কাউকে ঝুকিয়ে কপাল-টোকা খেলা খেলতাম, ছায়া খেলা খেলতাম, এক টিপ-দুই টিপ (চোর-পুলিশ) খেলা খেলতাম, আরো কতো খেলা ছিলো! 


সন্ধ্যায় দেড়ি হলে দৌঁড়ানো -টৌঁড়ানো খেয়ে এসে হারিকেন বা কপি জালিয়ে পড়তে বসতাম আপা-আমি। আম্মা পড়াতেন। এশার আজান দিলেই চেয়ারে হেলান দিয়ে অথবা টেবিলে পড়েই ঘুমিয়ে থাকতাম। আম্মা ঘুমন্ত মুখেই সামান্য খাইয়ে কোলে করে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিতেন। খালারা আসলে, খালাতো ভাই-বোনেরা মিলে কতো কেচ্চা-কাহিনী হতো। একটু পরপর "এরপরে-এরপরে" যতক্ষণ বলতাম ততক্ষণই কিচ্চা বলত, নাইলে বুঝতো ঘুমিয়ে গেছি আমরা। আবার পরের দিন বাকি কাহিনী শুনার জন্য ধরতাম সবাই। 


নদী-খাল-বিল-হাওর, ক্ষেত-খামার, গাঁও-গ্রাম ইত্যাদিতে দুরন্তপনায় কাটিয়েছি। কতো ক্ষেতের টমেটো, মুলা, বাঙ্গি, লম্বা আলো সাফার করেছি। আকাশে কতো আগুনের বুলাবুলি ( আগুন জ্বালিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আকাশে ছুঁড়ে মারা ) খেলেছি। পানিতে পড়লে তো উঠবারই নাম থাকতো না, কতো পিঠ-গরম খেলেছি, কুমির খেলা খেলেছি, কতো মামা-চাচা, দাদা-নানার দৌঁড়ানো খেয়েছি! এর বড়ই গাছে, ওর জাম গাছে, তার আম গাছে কতো ঢিল মেরেছি! আরেকজনের কলা গাছের কলা, কাঁঠাল গাছের কাঁঠাল, পিয়ারা গাছের পিয়ারা, নারিকেল গাছের ডাব-নারিকেল কতে উধাও করেছি!


আমাদের একটা দল ছিলো। যেখানে যেতাম একসাথে যেতাম, মসজিদে গেলেও একসাথে লাঠি-সোঁটা নিয়ে যেতাম, অন্য বাড়িতে গেলেও কোমরে চাবুক নিয়ে যেতাম। এগাঁয়ে-ওগাঁয়ে ওয়াজ-মাহফিল হলে কোনোটাই মিস হতো না, ওয়াজ মিস হলেও খিচুড়ির সময় ঠিকই হাজির থাকতাম। কোমরে চাবুক, ছোট-ছোট লাঠি, গোলাইল ( ধনুকের মতো গাছের বাঁকানো ঢাল দিয়ে রাবার লাগিয়ে ছোট-ছোট মাটির বানানো মার্বেল দিয়ে পাখি শিকার করে) ইত্যাদি কোমরে রেখে রাতের পর রাত চলতাম। ছিলাম দুর্দান্ত। ছিলাম দূরন্ত। ছিলাম নির্ভীক। ছিলাম নিশ্চিন্ত। 


কখনো কোনোদিন মাথায় আসেনি কোনো মেয়ে, কখনো মাথায় আসেনি শহুরের জীবনের এক ঘেয়েমি, কখনো মাথায় আসেনি ঝক্কর-ঝক্কর গাড়ির কান ঝালা-পালা করে দেওয়া আওয়াজ, কখনো মাথায় আসেনি হতাশা, কখনো মাথায় আসেনি একাকীত্ব। প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দ-উদ্দিপনায় কাটতো, প্রতিটা মুহূর্ত কাটতো বন্ধুদের সাথে, প্রতিরা মুহূর্ত কাটতো কখন ঘর থেকে বের হয়ে খেলায় যাবো, প্রতিটা মুহূর্ত কাটতো প্রকৃতির সাথে। কখনো জানতামই না ভার্চুয়ালিটি কী? জানতাম না ফোনে কেমনে কথা কয়? গরুর গাড়ির পুউউ-পুউউ আওয়াজ, নৌকার ইঞ্জিনের আওয়াজ আর মাইকের আওয়াজ ছাড়া কখনো কোনো আওয়াজই কানে আসতো না, প্রকৃতির সকল আওয়াজ এসে কানে দোলা খেতো। 

তাহলে মানুষের মাঝে কেনো আসবে হতাশা-ডিপ্রেশন। কেনো হবে মানুষ নিরাশ?  কেনো মানুষ জীবনকে অকাতরে রশিতে বেঁধে দিচ্ছে? 



অনেক কথা মনে পড়ে গেলো! আসলে, মানুষ যে স্মৃতি নিয়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে আমি আজ বুঝছি। এক দৌঁড়ে সায়দাবাদ। এসে শুনি রুহুল ভাই সাভার থেকে রওয়ানাই দেননি। চলে গেলাম সায়দাবাদ বন্ধু সেলিমের বাসায়। একটু বসতেই উর্মি আপু ফোন দিলো, 

"রেদ্ওয়ান, ঢবি ক্যাম্পাসে আসতে পারবা? আমার রেজাল্ট পুনঃ নির্ণয়ের ফরম তুলার জন্য যেতে হবে।" 

"আচ্ছা, আপু।"

ওনি ইডেনের ছাত্রী। সাত কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ঢাবিরা খুব খারাপ আচরণ করে জানতাম, কিন্তু কখনো নিজ চোক্ষে দেখার সুযোগ হয়নি। তাই আপুকে না বলতে পারিনি। 

এদিকে রুহুল ভাইকে বললাম, "আপনি ধীরস্থিরে আসেন।" 


চলে গেলাম উর্মি আপুর সাথে ঢাবির প্রশাসনিক ভবনে,,,,,,,, 



"ঢাবির কারুকার্যে যতো ক্ষত" দেখবেন আগামী 'ভবঘুরের রাজ্যদর্শনে'। ততক্ষণ পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। 


রেদ্ওয়ান আহমদ 

Comments

Popular Posts