Adcash

ভবঘুরের রাজ্যদর্শন ১

 আজ সারাদিন ভবঘুরের মতো একা-একা হেঁটে-হেঁটে রাজধানীর এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছি। 

সচিবালয়ের সামন দিয়ে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম, কতো নামী-দামী গাড়ি! হয়তো এগুলো একটাই আমাদের মতো কারো সারাজীবনের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। 

ভাবলাম, মানুষ গড়ার মেশিনটা একটু দেখে আসি। গেলাম ঢাবি ক্যাম্পাসে। কার্জন হলের বারান্দায় বসে বসে ভাবছিলাম, আহ! এতো সুন্দর জায়গা, এতো সুন্দর ভবন, শ্রেণিকক্ষ, কতো দামী অত্যাধুনিক পড়ালেখার সামগ্রী! এ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। আর এই সরকারি কোষাগার তৈরি হয় সেই গ্রামের কৃষক, জেলে, কামার, কুমার থেকে ধরে শহরের রিক্সাওয়ালা, দিনমজুরদের টাকায়। অথচ, তাদেরই আজ হাভাতে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হচ্ছে।  

জোহরের আজান দিলে রওয়ানা করি রমনার বটমূলে। পকেট একেবারে ফাঁকা। কথায় আছে না, ভিখারির পাও লক্ষ্মী। অবস্থা তাই-ই। হেঁটেই ছুটলাম। 

জাতীয় ঈদগাঁর পিছনের দিকে জজকোর্ট মসজিদ-মাজারর সামন দিয়ে যাচ্ছি, এমনই চোখে পড়ল খিচুড়ি দিচ্ছে। দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে, দেড়টা-দুইটা বাজে প্রায়, এ মুহূর্তে বাসায় গিয়ে খাওয়াও সম্ভব না। 

যাইহোক, ভাবলাম, রিজিক থাকলে পালাব কই?

হাতে সাপের লাঠি, পরনে সাদা ধুতি ও লাল জামা, মাথায় লাল ফিতায় তাবিজ বাঁধা কয়েকজন সাধুর সাথে প্লাস্টিকের থালা হাতে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে এক থালা শুকনা খিচুড়ি নিয়ে গাছের নিচে বসে খাচ্ছিলাম, এমনিই উপর থেকে টপাস করে কাকে পাঞ্জাবিটা নষ্ট করে দিল। আল্লাহর কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া কাকে পেটে লাথি দেয় নাই, নয়তো সন্ধ্যা পর্যন্ত উপোষই থাকতে হতো। 

পেট উঁচু করে নবাবের মতো হাঁটা ধরলাম জজকোর্টের সামন দিয়ে। বাঁধা দিল সিকিউরিটি, মানলাম না। ভিতরের গলি দিয়ে ঢুকলাম। বের হলাম একেবারে বার কাউন্সিলের সামন দিয়ে। বিশাল ভবন করতেছে বার কাউন্সিলের জন্য। মিনিমান বিশ-ত্রিশ কোটি টাকা বাজেটের কাজ হবে, আমার ধারণা নাই, একটা আন্দাজে বললাম। কিন্তু বার কাউন্সিলের কাজ কী সেটাই খুঁজে পেলাম না সারাদিন ভেবে। 

রমনা বন্ধ। দুর্বিপাকে পড়লাম। কী করি, কী করি! একটু আগ বাড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদিকরের গেইট দিয়ে প্রবেশ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বরাবর আগালাম। ছিটা কয়েক জোড়া কবুতর, পথশিশু, পাহারাদার আর ভিটাহীন মানুষ ছাড়া আর কিছুই তেমন চোখে পড়ল না। 

আরেকটু সামনে পা বাড়িয়ে অসাধারণ এক ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম, বাতাসে নাকে দোল খাচ্ছে। এক মহিলা হাতে ডলে-ডলে পুটলা বিলি করছে আর টাকা গুনছে। তারও আরেকটু সামনে আগালে অনেক ছাত্র-ছাত্রী গোল হয়ে বসে কিসের যেনো আলোচনা করছে। পাশেই একটা গাছের নিচে বসে পড়লাম। হঠাৎ দেখি, এক জোড়া যুবক-যুবতী দুজন দুজনের হাত ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে সামনের দূর্বাঘাসের উপর বসে। ধর্মে কী বুঝা গেলো না অবশ্য। উভয়ের বয়সই পঁচিশ-ছাব্বিশের কমে নয়। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে যুবক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে। তার চুলগুলো জটবাঁধা। পরনে থ্রি-কোয়াটার পেন্ট ও গেঞ্জি। মেয়েটির পরনে ছিলো বাঙ্গালী সংস্কৃতি বহন করা জামা। 

মাগরিব ছুঁই ছুঁই। বসা থেকে উঠেছি, শাহবাগ হয়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ভবনে বাতিঘরে যাবো৷ একটু সামনে যেতেই দেখি একদল লোক ঢোল-তবলা-একতারা বাজাচ্ছে। কাছে যেতেই চোখে পড়ে একটা ব্যানার। যাতে লেখা "সাপ্তাহিক লালন চর্চা কেন্দ্র"। বসলাম। ভাবলাম, এখনো তাহলে লালন চর্চা হয়! 

একাধারে কয়েকটা গান শুনলাম। এমনিই আরেক দম্পতি আসরে এসে উপস্থিত হলো। দম্পতি বিবাহিত না অবিবাহিত ছিলো জানি না, তবে আচরণে বিবাহিত দম্পতির কোনা অংশে কম ছিলো না। হঠাৎ দৌড়ে এসে এক পথশিশু মেয়েটিকে ঝাপটিয়ে ধরল। মেয়েটিও। একটু পর কোলে তুলে তার মাথার চুলগুলো ভাঁজ করে দিতে লাগল। পাশের অন্য শিশুটিকেও ছেলেটি কোলে নিয়ে দুজনেই সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে লাগল। চোখের অশ্রু ফোটা মাটিতে পড়ার আগেই তর্জনী দিয়ে বাঁধ বাঁধি। 

এদিকে লালন গীতি ভেসে আসছে,

"খোদা তোর মনে গোপন, তারে চিনসনি, 

 মানব, তারে চিনসনি,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

কুরানে মারেফত গোপন, প্রেমেতে কাম গোপন,

অন্তরে গোপন খোদা, তারে চিনসনি, 

রে মানব, তারে চিনসি,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,"








Comments

Popular Posts