Adcash

ভবঘুরের রাজ্যদর্শন ২

 

'ভবঘুরের রাজ্যদর্শন ২'

খিচুড়ি পাকানো হচ্ছে। আহ কী ঘ্রাণ! জিভে পানি এসে যাচ্ছে। লালন গীতিতে চারদিক মুখরিত, জিহ্বা লালায়িত খিচুড়ির ঘ্রাণে, চোখে নন্দিত পথশিশু আর মেয়েটিতে। যতোই অন্ধকার হচ্ছে, লোক সমাগম বাড়ছে। আর তাল মিলিয়ে বাড়ছে সমস্বরে লালন গীতি,


"সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে


ভজ মানুষের চরণ দুটি
নিত্য বস্তু হবে খাঁটি
মরিলে সব হবে মাটি
ত্বরায় এই ভেদ লও জেনে

সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে"

আহ কী চমৎকার জীবনদর্শন!

হঠাৎ, পাশে এসে একজন যুবকউত্তর লোক বসল। আমার সাথেই গানের তালে তালে দেহ হেলছে-দুলছে। এমনিই একটা সিগারেট টান দিয়ে বাতাসের সাথে ধোঁয়া ছেড়ে টান দিলো,

"জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবি দেখি তা না-না-না।।
আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে,
কি জাত হবা যাবার কালে
সে কথা ভেবে বল না।।"

চতুর্দিকে যখন অন্ধকার আর গানে ও সুরে মুখরিত, ঠিক তখনই এপাশ-ওপাশ হতে কী এক তীব্র ঘ্রাণ নাক ছিদ্র করে ঢুকছিলো। খিচুড়ির ঘ্রাণ নয়, জ্বলন্ত সিগারেটে দেশি গাঁজার ঘ্রাণ। তাই, আর বসে থাকার উপায় ছিলো না, খিচুড়ির লোভও আমাকে আটকাতে পারল না। চলে আসলাম ফটক পেড়িয়ে শাহবাগের দিকে।
দেখলাম, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠির ৫২ তমো প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠান হচ্ছে জাতীয় জাদুঘরের ঠিক সামনের রাস্তাটা আটকিয়ে রেখে। অবাকই হলাম, একটা সাংস্কৃতিক অঙ্গন, অথচ রাস্তা আটকিয়ে অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। যাইহোক, একটা লাইটপোস্টের নিচে বসে পড়লাম। সামনে একটা খালি চেয়ার দেখতে পেয়ে আর কাউকে সুযোগ না দিয়ে চট করে চেয়ারটার দখলদার হলাম। পাশের চেয়ারটায়ই বাংলাভিশনের সাংবাদিক বসা, সামনে জমুনা টিভি, টুয়েন্টি-ফোর, এটিএন-বাংলা ও আরো অনেক টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা শুটিংয়ে ব্যস্ত। আমি শুটিংই বললাম, এর কারণ একটু পরই ব্যাখ্যা করছি।
অনুষ্ঠানটি শুরু হলো দুটি মেয়ের একটি নৃত্য পরিবেশন দিয়ে। এরপরই বক্তব্যের পালা। প্রথমেই ডাকা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন শিক্ষককে। নামটা তাহমিদ না তামজিদ, আমার সঠিক মনে নেই। মধ্য বয়স্ক, লম্বা-চূড়া, সাদা চুল, ক্লিনসেভ। কথা খুব সুস্পষ্ট তার।

ওনি একাধারে বাংলাদেশের রাজনীতি, সাংবিধানিক অবকাঠামো, পরিচালনা পর্ষদ, রাজনৈতিক অবস্থা, উপনিবেশবাদ ও সংস্কৃতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। যখন ওনি বর্তামান সরকার, রাজনীতি, সংবিধান ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করন নিয়ে কথা বলছিলেন তখনই পাশ থেকে ফিসফিস আওয়াজে শুনতে পাই, "এই এসব কাটে তাড়াতাড়ি, কাটো তাড়াতাড়ি।" চেয়ে দেখলাম, সাংবাদিক আপুটা তার ক্যামেরাম্যানকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছে। মনে হলো, সিনেমার শুটিং হচ্ছে। এক্টিং ভালো হয়নি বলে, ডিরেক্টরের 'কাট-কাট' শব্দ উচ্চারিত হলো। এটাকে এক ধরনের হলুদ সাংবাদিকতাও বলা যেতে পারে। এজন্যই বলেছিলাম, সাংবাদিকেরা শুটিংয়ে ব্যস্ত। যাইহোক, স্যারের বক্তব্যে আসা যাক।
স্যার যখন আলোচনা করছিলেন, "ধর্মীয় অপসংস্কৃতি আজ শুধু শহরে-গঞ্জে না, পাড়াগাঁয়ের বাসা-বাড়িতেও ছড়িয়ে পড়েছে। স্যার আলোচনার ফাঁকে একটা গল্প হাকালেন। গল্পটা এমন, "একদা তিনি ঠাকুরগাঁও একটি পারিবারিক কারণে গিয়েছিলেন। ওখানকার একটা বাসে উঠে ওনি দেখতে পেলেন, একদল নারী শাড়ি পরে সিটে বসে আছে, আরেক দল নারী সম্পূর্ণ হিজাব পরে বসে আছে। হিজাব পরা একটি মহিলার পাশে ওনি যেয়ে বসে। হটাৎ ওনি মহিলাটিকে প্রশ্ন করে,
" আপনারা শাড়ি পরেন না?"
"না।"
"কেনো?"
"শাড়ি মুসলমানদের পোশাক না। শাড়ি পরলে পেট দেখা যায়, তাই শাড়ি পরি না।"
"শাড়ি মুসলমানদের পোশাক নয়, কোথায় পেয়েছেন?"
"আমাদের মহিলাদের বাসায় বাসায় তাবলিগ থেকে তালিম হয়। সেখানে বলেছে, শাড়ি মুসলমানদের পোশাক না, তাই পরা যাবে না।"

তারপর স্যার আর বেশি কথা বললেন না ওনার সাথে।


অতপর স্যার তার বক্তব্যে বলছেন, যেসব ধর্মীয় সংস্কৃতি অন্যের সংস্কৃতিটাকে শত্রু বা ঘৃণার চোখে দেখে, তারা তো সমাজের মানুষগুলোকে বিভক্ত করে দিচ্ছে। মানুষকে মানুষের চোখে দেখছে ন। তাদেরকে আরেকটা জাতিতে রূপান্তর করছে। সব কিছুর দায় রাষ্ট্রের বৈ অন্য কারো না। আমাদের সরকার আজ এমনভাবে সংবিধান তৈরি করেছে যে, ধর্মও আছে, আবার ধর্ম নিরপেক্ষতাও আছে। সবার সমানেই মুলো ঝুলানো।"

ভাবলাম, স্যার একটা অঞ্চলের উদাহরণ এসে রাজধানীতে দিচ্ছে। তার কথা সঠিক তো নাও হতে পারে। তাই বলে, ধর্মীয় সংস্কৃতির অপব্যাখ্যা তে দাঁড় করানো ঠিক না। যেমন, শাড়ি পরে কেউ যদি ব্লাউজটা কোমর পর্যন্ত পরে, তাহলে সেটা ইসলাম পরিপন্থী কাজ হলো না। মহিলাটি হয়তো ভুল বলেছে। হয়তো, ওনার সঠিক জ্ঞানের অভাব আছে। তাকে সঠিকটা জানানো উচিত। উল্টো তাকে উদাহরণ হিসেবে টানা হচ্ছে।
জাতি ভাগ হচ্ছে ধর্মের কারণে না। হাজার বছর যাবৎ মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধরা একি সাথে বসবাস করে এসেছে ভারতীয় উপমহাদেশে। তাদের মাঝে সম্প্রিতি ছিলো বিধায় সম্ভব হয়েছে। বরং বলা যায়, এসব অজ্ঞানতার কারণে জাতি ভাগ হচ্ছে,  মানুষকে ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে। ওই মহিলাটাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনেও তার প্রতি এক ধরণের ঘৃণার সৃষ্টি করা হয়। 

কিন্তু আবার ভাবনা এলো, বাসের মহিলাটা যে সম্পূর্ণ হিজাব পরা ছিলো। সেখানে মহিলাটি হিজাবের নিচে শাড়ি পরা ছিলো না বুঝলেন কীভাবে?  আর মহিলাটাও তো আগ বাড়িয়ে কিছু বলেননি। ভেবে কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। যাইহোক, ওটা স্যারের বিষয়।

একপর্যায়ে স্যার আবারও বলছেন, "ফ্রান্সের একজন সরকার প্রধান একটা মিটিংয়ে একটা কথা বলেছেন, সেটা নিয়ে সারা বিশ্বে কী সব চলছে এটা আর বলার কিছু না।"

যেখানে ধর্ম আছে, সেখানে ধর্মীয় সংস্কৃতি থাকবে, দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে, উগ্রতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ইত্যাদি হলে সেটা অপরাধ। ভুল শিক্ষা, উদাহরণ, তথ্য দেওয়াও আমার মতে অপরাধ।

যাইহোক, স্যারের বক্তব্য অনেকটা দীর্ঘ হওয়ার কারণে অন্য ব্যক্তিদের বক্তব্য শোনার সময় হয়ে উঠেনি। এশার আজান পড়ছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে আসি। ওই একটা চেয়ারের জন্য পিছনে তাকিয়ে দেখলাম কয়েকজন হা করে আছে। হয়তো গিলেই খাবে। তবে, সভ্য মানুষেরা ছেড়ে দিয়ে জিতে যেতে চায়।

"চোখ রাখুন টাইমলাইনে
পরবর্তী রাজ্যদর্শনের অপেক্ষায়"

~ বেদনার ফেরিওয়ালা

Comments

Popular Posts