Adcash

ভবঘুরের রাজ্যদর্শন ৩

 "মাজারের শিরনী খাইলে নাকি শরীল-গতর ভালো অয়" দরবেশ বাবার কথা। উল্টো দুদিন ধরে আমাশা আর পাতলা পায়খানা পালাক্রমে বেড়েই চলেছে। কাল সকালে একটা অফিসে ইন্টারভিউ ছিলো। 'জনসেবা' পদে নিয়োগ। সাধারণ মানুষ যেটাকে 'পাবলিক সার্ভিস' বা 'কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস' বলে। আসলে আমরা যে ধীরে-ধীরে স্বকীয়তা হারাচ্ছি, তারই একটা নিদর্শন এই ইংরেজি মুখো অবস্থা। অবশ্য চিন্তারও কারণ নেই। আসলে আমি বাংলা ভাষাটাকে মাঝে-মধ্যে মজা করে 'সংকার ভাষা'ও বলে থাকি। বাঙালী জাতি যেমন বিভিন্ন জাতির সংস্পর্শে আজ পরিপূর্ণ একটি জাতি, তেমনই বাংলা ভাষারও বিভিন্ন ভাষা থেকে ধার করে পরিপূর্ণ একটি ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ। যাইহোক, আমি ভাষা বিজ্ঞানী নই, এমনকি ভাষাতত্ত্বেও ডিগ্রি নেই আমার। পাগলামোর বশে এমনটা হয়ে থাকে। ইন্টারভিউ অফিস মতিঝিল। রায়েরবাগ থেকে দশ টাকা নয়তো পনের টাকা ভাড়া। অবশ্য দশ টাকা বলারও কারণ আছে। সরকারী বিআরটিসি বাস ছাড়া এখন আর কোনো বাসকে দশ টাকা আর বুক উঁচু করে থামিয়ে দেওয়া যায় না। হেল্পারও একজোট।মার ছক্কা, ঠেকায় কে? 


আমাদের মতো সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা পরেছে মহা বিপাকে। প্রতিষ্ঠানগুলে বন্ধ বিধায় টিউশনগুলোও গেলো। পার্ট-টাইম চাকুরি থেকে সব ছাটাই। কী-বা করবে? তারা নিজেরাই তো চলতে পারছে না! যার কারণে, ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা বর্তমানে হয়েছে সবচেয়ে খারাপ। হাফ পাশ নেই, টিউশন নেই, পার্ট-টাইম চাকুরি নেই। ক্যাম্পাসের গ্যাং নেই, তাই গলা উঁচিয়ে কথা বলাও সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চ-মাধ্যমিকে পড়া কালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করে কতো বাসের টাকা হাফ রাখতে বাধ্য করলাম। আর আজ আসল ঢাবিয়ান আর জাবিয়ানরাই হাফ ভাড়া দিতে পারছে না। 

বলে না, কপালে শনি থাকলে সব বারই শনিবার লাগে!


রায়েরবাগ গ্যাসরোড থেকে একটা গলির ভিতরে ঢুকে চোখ বন্ধ করে হাঁটা ধরলাম। হেঁটে হেঁটে যাত্রাবাড়ী গিয়ে পৌঁছব একেবারে। হাঁটছি আর হাঁটছি। ফুরচ্ছে না যেনো হাঁটা। এক প্রকার জেদ করেই হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঘর থেকে শুধু বলে, আমি চোখের ভুখে খাই, পেটের ভুখে খাই না, তাই পেটের এই অবস্থা। ভাবলাম, রিক্সা চালক, দিন মজুর, কৃষকদের নাকি সব অসুখ-বিসুখ পেট খারাপি নাকি পিঠ দিয়ে ঘামের সাথে বেয়ে-বেয়ে বের হয়। আমিও আজ পিঠ না শুধু, সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরাব। দেখি পেট খারাপ কীভাবে ভালো হয়?


যাত্রাবাড়ী থানা পাড় হয়ে গলির ভিতর কয়েক চক্কর ঘুরতে-ঘুরতে কদমতলী থানার জুরাইনের মুরাদপুরে ঢাকা টু মাওয়া বিশ্বরোডের ফ্লাইওভারের নিচে যেয়ে হা করে তাকিয়ে থাকি। ডান দিকে একটু-একটু করে আগাতে থাকি।

"এটা কোন জায়গা, ভাই?" জিজ্ঞেস করলাম একজনকে।

"জুরাইন।" ছোট্ট করে উত্তর দিলো লোকটি।

বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাইনি। যদি আমাকে বোকা ভাবে। সে সুযোগ দেয়া যাবে না। কিন্তু যাত্রাবাড়ী সামনে না পিছনে বুঝতে পারছি না। এখানে কখনো আসছি কিনা তাও জানি না। দোকান-পাটের উপরে জায়গার নাম খুঁজি। মুরাদপুর, জুরাইন লেখা। হ্যা, ঠিকই তো আছে। কিন্তু, আমি তো যাবো যাত্রাবাড়ী। যাত্রাবাড়ীটা কোথায়? সামনে, না পিছনে? একজনকে সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, 

"ভাই, যাত্রাবাড়ী এদিকে, না ওদিকে?" 

"এদিকেই।"

আরো দশ মিনিট হাঁটতে-হাঁটতে শরীরে কাহিল নেমে এলো। জুরাইন থেকে যাত্রাবাড়ীর দূরত্ব আর রায়েরবাগ থেকে যাত্রাবাড়ীর দূরত্ব প্রায় সমান। 

সুতরাং, ফলাফল শূন্য,

হাঁটা ফ্রি। 

কথায় আছে না, গুড়ের লাভ পিঁপড়ার মুখে। 


হাঁপাচ্ছিলাম। তাই, বাসে না উঠে আর পারলাম না।  বাধ্য হলাম বাসে উঠতে। নামব, এমন সময় হেল্পার বলল, "ভাই, ভাড়া হয়েছে?" অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। পকেট থেকে গুণে-গুণে তিনটা এক টাকা পয়সা আর একটা দুই টাকা পয়সা বের করে হেল্পারের হাতে ধরিয়ে দিলে হেল্পার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে থাকো।

আমার ভালো লাগছে এ ভেবে যে, এই ঘটনায় আমি এ দেশের এক ধরনের সহজসরল, গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছি।



মতিঝিল অফিসে পৌঁছতে-পৌঁছতে প্রায় দশটা বেজে গেছে। অবশ্য ইন্টারভিউ নেয়ার আরো পাঁচ মিনিট বাকি। ঠিক ফ্যানের নিচে বসলাম। ফ্যানের ঠিক নিচে যে বাতাস কম লাগে সেটা তখন এক প্রকার ভুলেই গেলাম। প্রায় সত্তর-আশি জনের মতো বেশ সুদর্শন ছেলেদের ভীড়ে এক শ্যাম বর্ণের পাপী আমি। তার মাঝে গোটা কয়েকজন মেয়েছেলেও আছে। তারা যে ঘষামাজার পরিনতিটা এখানে এসে ভুগছে, তা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল। সবারই সাদা পোশাকে গলায় টাই ঝুলানো। মনে হচ্ছে যেনো, প্রাইমারিতে স্যার যখন পিটিতে ডাকতো তখন এভাবে সবাই টয়লেটের আয়নার সামনে যেয়ে ভীড় জমাতো। ঠিক তেমনি একেক জন টাই-টুই নাড়া-চাড়ি করে-করে দেখছে ঠিক আছে কিনা। শার্ট কোথায় ফুুলে আছে, কোথায় কুঁচি পড়েছে, পেন্টের কোথায় ময়লা লেগেছে ইত্যাদি। ভিতরে যাওয়া শুরু হলো। কয়েক জন মুখ গামলার মতো করে বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে সবার ব্রেনকেই একবার করে টর্চার সেলে পাঠানো হয়েছে। হঠাৎ আমার ডাক পড়ল। এই প্রথম 'সাহেব' ডাক শুনলাম। আহ, কী যে ভালো লাগতেছিলো! কী জানি এরপর কী হয়! 

মাথার উপর ফ্যান, স্যার রিমোট হাতে এসির পাওয়ার আরো বাড়িয়ে দিলেন। একজনকে খেয়ে ফেলতে পাঁচজন সমানে হা করে আছে। আল্লাহয়ই জানে, কতোদিন যাবৎ যে না খেয়ে আছে! একমাত্র শিকার আমিই মনে হচ্ছে। এই বুঝি গিলে খাবে।


প্রচন্ড ঘামছি। ঘাম নিয়েই বের হলাম টর্চার সেল হতে৷ একজন সামনে এসে কী উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 

"ভাই, কী জিজ্ঞেস করেছে ভিতরে?"

ভাবলাম, কী জিজ্ঞেস করেছে তাতো একমাত্র আমিই জানি। আপনাকে বলে কি নিজের কপালে নিজে ঝাটা মারব? 

"ভাই, অনেক কিছুই তো জিজ্ঞেস করল। কোনটা রেখে কোনটা বলব! ভিতরে গেলেই বুঝতে পারবেন কী জিজ্ঞেস করল।"

আমার নামটা আর কোথায় পড়েছি জিজ্ঞেস করে ছেড়ে দিয়েছে। এমন করেছে আরো অনেকের সাথেই। বেশি কিছু প্রশ্ন না করার অর্থই চাকুরিটা আর হচ্ছে না। যেহেতু পদটা পাবলিক সার্ভিস, সেহেতু এতো-এতো সুদর্শন ও সুন্দর ছেলে-মেয়ের মধ্যে আমাকে তারা গুণায়ই ধরবে না। যদিও বর্তমানে এই পাবলিক সার্ভিসগুলোতে মেয়েদের চাহিদাটাই বেশি। কেনো, সেটা না হয় না-ই বললাম। বললে, চাকরি নাই, আর চাকরি হবেও না হয়তো। 'থাকবে না' বলে আর কী করব?



মাথা চল্লিশ ডিগ্রি হয়ে আছে। গুলিস্তান যাবো? নাকি সায়েদাবাদ হয়ে চলে যাবো? হাঁটা ধরলাম রায়েরবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারের পাশ দিয়ে শান্তিনগর দিয়ে। জোহর আজান পড়ল। মাথা গরম। হাঁটছি আর হাঁটছি। কোথাও উঁচু-নিচু। হোচটও খাচ্ছি। একটা মসজিদের পাশ দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ মসজিদের সামনে নজর পড়ল। এক সারি ভিক্ষুক। পুরুষ-মহিলা ভেদাভেদ নেই। এক সারিতেই সবাই দাঁড়িয়ে আছে। নামাজ পড়ে পড়ে সবাই বের হয়ে যাচ্ছে, কেউ পকেট থেকে ছ্যাঁড়া-ফাঁড়া কিছু থাকলে বের করে বাটিতে রাখছে। কেউ বা সরে দাঁড়ান, সরে দাঁড়ান বলে জুতা পায়ে পরছেন। মসজিদে ফ্যান ঘুরছে অবিরাম। এসিও হাইস্পিডে বাতাস ছাড়ছে। বাহিরে রোদে দাঁড়িয়ে ভিক্ষুকেরা বাটি সামনে পেতে রেখেছে। টাকা কিছু পড়ছে বাটিতে ঠিকই, কিন্তু সে টাকা ঘৃণার, না ভালোবাসার চিনা গেলো না। কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশকেউ দেখলাম বের হয়ে মানিব্যাগ থেকে দুই টাকা বের করে রাখলেন। অপর পাশে চেয়ে দেখলাম, আরেক পুলিশ এক ট্রাকচালকের কাছ থেকে দুইশো টাকা নিলেন। 


মনে হচ্ছিল ভিক্ষুকদের গিয়ে বলি, "ওই শালারা, মসজিদের ভিতরে গিয়া আগে সব এসি ভাঙ্গ। বল, "বাহিরে আমরা রোইদে পুড়ি আর ভিতরে তোরা এসির নিচে নামাজে দাঁড়াইয়া ব্যবসা কষোস?" দেখবি, তোদের চাকরি হইয়া গেছে। মাইগা খাওনের দিন নাই। কাইড়া খাওনের দিন অখন।" 



মাজারের শিরনী পেট ভালো না করতে পারলেও কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুরদের দেয়া পরামর্শে পেট ভালো হয়ে গেছে। দুদিন যাবৎ যে চিড়া-স্যালাইনের উপর ছিলাম, রাতে সব প্রতিশোধ একেবারে নিলাম।

রাতে স্বপ্নে দেখছিলাম, একদিন আমি রিক্সা চালাচ্ছি, আরেকদিন কৃষক হয়ে জমিতে ধান বুনছি, আরেকদিন মসজিদের এসিগুলো ঠাস-ঠাস করে ভাঙ্গছি। 


রেদ্ওয়ান আহমদ 




Comments

Popular Posts