Adcash

আবির (গল্প)

 


গ্রামের হেলাল খাঁন ও রূপালী বেগমের একমাত্র ছেলে আবির। আট-দশজন ছেলের মতো সুদর্শন না হলেও সে ছিলো অত্যন্ত পরিশ্রমী ছেলে।পরিশ্রম করে করে সে স্কুলের সেরা মেধাবীদের একজনে পরিনত হয়ে উঠেছিলো। এ বছর এসএসসি পরীক্ষাতেও গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে সে। বলতে গেলে এই মেধাবীই তার একমাত্র গুণ। ক'দিন হলো কলেজেও ভর্তি হয়ে আসলো। এখনও ক্লাস শুরু হয় নি। তবে, জুলাই থেকেই ক্লাস শুরু হবে। আবির মানবিকের ছাত্র। গ্রামে সাইন্সের তেমন টিচার পাওয়া যায় না, তাই সবাই সাইন্স পড়তে চায় না। আর যারা পড়ে, তাদের সাইন্সের বিষয়গুলো নিয়ে খুব ভ্যাবাচেকা খেতে হয়। আবির খুব সাহিত্য প্রিয় একজন ছাত্র। ধার্মিক ছেলেও সে, যদিও গান-কবিতাই তার পছন্দ তালিকার শীর্ষস্থান দখল করে আছে। তবে, ওয়াজ-মাহফিলেও খুব সুরেলা কণ্ঠে তাকে গজল গাইতে শুনা যায়। 


প্রতিবছরের ন্যায় এবারও গ্রামে মেট্রিক পাশ ছেলেদের অভিনন্দন জানাতে কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাথে সাংস্কৃতিক পরিবেশনাও। স্কুলের সেরা রেজাল্ট ধারীদের মধ্যে আবিরও একজন। কেউ কুরআন তেলাওয়াত করলো, কেউ বক্তব্য দিলো, কেউ আবার গান গাইলো। আর আবির কবিতা আবৃত্তি করলো। সবাই তার আবৃত্তি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো। সবার হাত তালিতে সে স্টেজ থেকে নেমে এসে আবার চেয়ারে বসলো। হঠাৎ, পেছন থেকে মৃদু স্বরে কে যেনো বলে উঠলো,

"আপনে তো খুব সুন্দর কবিতা গাইতে পারেন! খুব ভালো লগেছে কবিতাটা"। 

হটাৎ এমন প্রশংসা শুনে আবির পেছন তাকিয়ে দেখলো ঠিক তার পেছন বরাবর চেয়ারটিতে একটি মেয়ে বসে আছে। মাথায় ঘুমটা দেয়া। কপালে একটা দুইটা চুল এসে দুল খাচ্ছে। মুখে মৃদু হাসির ঝলক। আবির যখন বললো,

"কবিতা কিন্তু গায় না আবৃত্তি করে"।

এমন উত্তরের জন্য হয়তো মেয়েটা প্রস্তুত ছিলো না। আকস্মিক মেয়েটার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেলো। খানিকটা ইতস্ততবোধ করে মাথার ঘুমটা টানলো। কপালে উড়ে আসা চুলগুলো সব আঙ্গুলে দিয়ে ভিতরে টেনে নিলো। আবির পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, 

"আপনার নাম কী?"

মেয়েটি কোনো উত্তর দিলো না। 

"আপনার বাড়ি?"

এবারও কোনো উত্তর দিলো না। 

আবির খানিকটা বিরক্ত হয়ে আর কোনো প্রশ্ন না করে আবির সামনে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অনুষ্ঠান শেষে আবির পুরস্কার হাতে বাড়ি চলে আসে।


বিকেলে আবির নদীর পাড়ে হাটছে আর ভাবছে, "কে হতে পারে মেয়েটা? বা কোন বাড়ির হতে পারে জানতে হবে। বা এমনই বা করলো কেনো আমার সাথে?" 

যে আবির পড়ার জন্য খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত ভুলে যেতো, সে আবির আজ ভাবছে একটি মেয়েকে। তাও আবার উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো। 



আজ ফুটবক খেলা খাঁনবাড়ি বনাম মোল্লাবাড়ি। দর্শকে ভরা মাঠের চতুর্পাশ। এই সময়টাতে পানি ঘাট থেকে একটু দূরে থাকে। পানি আসবে আসবে কেউ কোনো ফসলও ফলায় না। যার কারণে খেলার জন্য ভালো মাঠও পাওয়া যায়। শুরু হলো খেলা। টানটান উত্তেজনা দর্শকদের মধ্যে। প্রতিটা দর্শকই মাঠের বাহির থেকে একেকটা কোচ। শর্ট বা গোল মিস করলে গালি একটাও মাটিতে পড়ে না। টানটান উত্তেজনার মধ্যে হঠাৎ দক্ষিণা বাতাসে শিহরণ জেগে উঠলো আবিরের চোখে। সে দেখতে পেলো মাঠ বরাবর বাড়ির উপর থেকে অনেকগুলো মেয়ে-মহিলাদের মধ্যে ওই মেয়েটাও দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। আবির প্রথমত চোখকে বিশ্বাসই করতে পারলো না। খেলা তার উবে গেলো। আর কারো দিকে তার দৃষ্টি নেই। ওই মেয়েটির দিকেই সে চেয়ে আছে। হটাৎ সে দেখলো মেয়েটির মন খারাপ হয়ে উঠলো। মাঠে চেয়ে দেখলো মোল্লাবাড়িকে এক গোল দিয়ে ফেলছে খাঁনবাড়ি। আবির না পারে মাঠে নেমে তার নিজের বাড়িকে নিজেই গোল দেয়। মেয়েটির মন খারাপ। খাঁনবাড়ি গোল খেলে হয়তো মেয়েটি খুব খুশি হতো। কিন্তু আবির তা পারবে না৷ মাঠ ভরা উত্তেজনা নিয়ে খাঁনবাড়ির ফুটবল টিম মিছিল দিতে দিতে চলে গেলো। আবিরের মন খারাপ। 


পরেরদিন সকাল সকালই বলা-কওয়া ছাড়া আবির তার নাসিমা আপার বাড়ি চলে এলো। আসতেই নাসিমা আপা আবিরের কান ধরে টান দিয়ে বললো, 

"কিরে, কালকে খেলার সময় তোরে কতো ডাকছি, জবাব দেস নাই কেন?"

"কোন সময় ডাকছো?"

"খেলার সময়।"

"শুনি নাই"।

"না শুনলে ডাকার সময় বাড়ির দিকে কার দিকে চাইয়া আছিলি, বল?"


আবিরের বুঝতে আর বাকি রইলো না, তার নাসিমা আপা তাকে কাল খেলার সময় বাড়িতে চেয়ে থাকতে দেখছে। তাকে কোনো ভাবেই বলা যাবে না যে, ওই মেয়েটির জন্য সে এভাবে বাড়ির দিকে চেয়ে আছিলো। 


"আপা, তুমি হেদিন বাড়িত গেছিলা, কিন্তু আমার লগে দেখা করো নাই এল্লাইগা আমি তোমার কথার কোনো সাই দেই নাই।"

"তোরে বাড়িত গেলে পাওয়া যায় যে, তোরে দেইখা আমু! আর ঘরে জানোস তোর দুলাভাই আছে। তারে রাইখা কি আর বেশিক্ষণ বাড়িত গিয়া থাকুন যায়?"

"হ, অইছে। এখন কতো কথাই কইবা!"

"বাদ দে, এইগুলা। বল, হঠাৎ আমার ঘরে চাঁনরাইত কেন?"

" আপা, জানোই তো কলেজো ভর্তি হইছি। কয়দিন পরেই চইলা যাইতে অইবো। এর আগে কোনো ভালো কইরা শহরো থাকি নাই। আর অহন দিন-রাইত পইড়া থাকুন লাগবো। তোমরারে কয়দিন পরে পরে দেখতাম পারমু আল্লায়ই ভালা জানে। হেল্লাইগা তোমরারে দেখতাম আইছি।"

"এমন কইরা কইস না, ভাই। চোখো পানি আই পড়বো।" 

এই কথা বলেই নাসিমা আপা গড়গড় করে কেঁদে ফেললেন। আবিরকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, 

"তুই, এই  আপাডারে কখনও ভুলিস না।"

আবিরও কাঁদছে। 

দুইতিন বছরের বড় আবিরের নাসিমা আপা। আবিরের আপন চাচাতো বোন সে। মার পেটের বোনও এমন হয় না অনেকের দাবী। ছোট থেকেই একি সাথে বড় হওয়া তাদের। আবিরকে ছোটবেলা বেশি নাসিমা আপাই রাখতো চাঁচির কাজে-কামের সময়। নাসিমা আপার সাথে থাকার কারণে আবির কতো বকা শুনেছে, কতো কথা শুনেছে, কতো মারও খেয়েছে! গোলি খেলা, চারা খেলা, গোল্লা খেলা এই সব খেলা তার নাসিমা আপাই তাকে শিখিয়েছে। বড়ই, আম, জাম, কামরাঙ্গা টোকাতে, ডিম কুড়াতে, বিলে শামুক কুড়াতে নাসিমা আপার একমাত্র সঙ্গীই ছিলো আবির। আরো কতো কী! নাসিমা আপার ছোট বেলার প্রতিটা স্মৃতি যেনো আবিরকে ঘেরা। আর আবিরের ছোট বেলাটাই যেনো নাসিমা আপাকে ঘেরা। সেই নাসিমা আপার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় অনেকদিন আবির নাসিমা আপার সাথে কথাই বলে নি। তারপর আস্তে আস্তে ক্ষোভ ভেঙে যায়। এরপর যখনই সময় পেতো আবির নাসিমা আপার বাড়িতে চলে আসতো। নাসিমা আপাও যখন সংসার নিয়ে ব্যস্ত, তখনই আবির পড়ালেখায় মন দেয়। নাসিমা আপার জন্য তার তেমন বন্ধু-বান্ধবও হয়ে উঠে নি। ধীরে ধীরে নাসিমা আপা সংসারী হয়ে উঠে, আর আবিরও পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে উঠে। এভাবেই তাদের দীর্ঘ স্মৃতি অতীত হতে শুরু করে।


Comments

Popular Posts