Adcash

কলমের ভার

আমি এক বেনামি জেলা দায়রা আদালতের প্রধান বিচারপতি। দীর্ঘ সতেরো বছর অতিক্রম করিয়াছি উক্ত পেশায়। পেশাটা লুফে লইতে আমাকে কাল বৈশাখীর ঝড়-ঝাপটা প্রবল বেগে পোহাইতে হইয়াছিল। চাক্ষুষ কতো নবীন-প্রবীন নিকটস্থ জেলা হইতে উধাও হইয়াছেন তাহা আর আমি অদ্য হিসেব কষি না। বার্ধক্যজনিত কারণে স্মরণ রাখিতে পারি না হয়তো। তাহারা তাহাদের যথাস্থানে টিকিতে সমর্থ হয় নাই। অথচ, আমি স্বস্থানে নিশ্চল। নিজস্ব কিছু সূত্র প্রয়োগে আমার অদ্যবধি সফলতা। যাইহউক, মাথা না থাকিলে মাথা ব্যাথাও থাকিবার কথা নয়৷ সুতরাং, সেইদিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া স্বীয় আলোচনায় মনোযোগ দেওয়াই বুদ্ধিমানের কম্য হইবে। 


"দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।" ইহা লিখার সার্থকতা ও ব্যাখ্যা শীঘ্রই আলোচনা করিতেছি। 


আমার জেলায় এক রাজমিস্ত্রী দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর যাবৎ উক্ত কাজ করিতে-করিতে প্রকৌশলী হইয়া গিয়াছেন। তাহাকে যে ব্যক্তি নিজের প্রাসাদ গড়িতে লইতে পারল, সে ব্যক্তি প্রকৌশলীর ব্যয় হইতে যেনো হাফ ছাড়িয়া বাঁচিল। তাই, তাহার বাজার দরও অদ্য খানিকটা চড়া। 


এক সময় সে রাজমিস্ত্রী এক দশতলা ভবন নির্মাণ আরম্ভ করিল। কিন্তু ভিত গড়িবার কালে কুফা আসিয়া তাহার ঘাড়ে বর্তাইল। স্থানীয় এক প্রকৌশলী তাহার বিরুদ্ধে আমার আদালতে মামলা করিয়া লইল "সে নাকি শিক্ষাগত যোগ্যতা বৈ ভবন নির্মাণ করিয়া মানুষদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলিতেছে"। মামলা আদালতে শুনানি হইলে উভয়কেই উপযুক্ত প্রমানাদি পেশ করিতে এক সপ্তাহ সময় প্রদান করা হইল। 


এক সপ্তাহ শেষে পুনরায় শুনানির দিবসে রাজমিস্ত্রীর কর্মে নিপুণতা দেখিয়া আমি বিস্মিত হইলাম। একদিকে সনদধারী প্রকৌশলীর সমস্ত কাগজ-পত্তর, দলিলাদি, কনস্ট্রাকশন-চিত্র এবং তাহার যাবতীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা পেশ করিল। অন্যদিকে ক্ষুদ্র রাজমিস্ত্রী তার ও বেত কর্তৃক নির্মিত এক দ্বিতল বিশিষ্ট ভবন ন্যায় খাঁচা আমার হস্তে দিয়া বলিল, " বিচারক মহোদয়, গ্রন্থস্থ বিদ্যা কর্মক্ষেত্রে না প্রয়োগ করিয়া সনদে প্রয়োগ করিলে তবেই মানুষ ঝুঁকিতে পরিবে"। তাহার উক্ত জ্ঞানগর্ভ কথা শুনিয়া আমি থ বনিয়া গেলাম। আসলেই তো সনদ লাভ করিয়া যদি কার্যে তাহা প্রয়োগ না করি তাহইলে উক্ত সনদের সার্থকতাই তো রহিল না। প্রকৌশলীকে শুধাইলাম, "আপনি পাশ করিয়াছেন কবে?" উত্তরে কহিল, "গত বৎসর।" পুনরায় বলিলাম, "কোনো কার্য-যোগ্যতা রহিয়াছে আপনার?" সে বলিল, "তেমন কোনো বড় কার্য করি নাই। তবে আমার প্রতিষ্ঠানের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং হইতে আমি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হইয়া পাশ করিয়াছি। তাহার প্রমাণও আপনার হস্তে পেশ করিয়াছি আমি।" 


অতঃপর, উভয়ের নিজস্ব যুক্তি-তর্কে কাহাকেউ ছাড়িবার উপাই দেখিতে পাইলাম না। ভাবিলাম, উভয়ের কার্য যোগ্যতা নিজচক্ষে পর্যবেক্ষণ করা যাউক। সময় নির্ধারণ করা হইল। গেলামও। প্রথমেই রাজমিস্ত্রীর দশতলা ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনাগুলোও সরকারী প্রকৌশলী লইয়া ঘুরিয়া-ফিরিয়া দেখিলাম। ত্রুটি ধরিতে সাহস হইল না। সত্যিই তাহার কার্য অসাধারণ শৈলীতে নির্মিত। অপরদিকে প্রকৌশলীর এক দুতলা স্থাপনা প্রদর্শন করিতে গিয়া প্রথমেই চোখের সম্মুখে দেখিতে পাইলাম বেজ ও পাইলিং একটাও ঠিকঠাক করিতে পারে নাই। 


অতঃপর আমি রাজমিস্ত্রীর পক্ষেই রায় প্রদান করিলাম। কিন্তু তাহার কয়েকদিন অতিক্রম করিবার পরই আমাকে উক্ত জেলা ছাড়িয়া অন্য জেলায় স্থানান্তরিত হইতে হইল। 


সতেরো বছরের বিচার কার্যে যেই সূত্র প্রয়োগ করিতাম তাহা প্রয়োগ সমাপ্ত কিরিয়া দিলাম। যার ফলশ্রুতিতে আমাকেও উক্ত জেলার বিচারকার্য সমাপ্ত ঘোষণা করিতে হইল। 

সারাজীবন কলমের খুঁচাখুঁচি করিয়া অন্যের ভবিষ্যত গড়িলাম। অথচ, অদ্য অন্যের কলমের খুঁচার ভার বহিতেই সমর্থ হইলাম না। 

অতঃপর, সে বেচারা রাজমিস্ত্রীও কলমের আঘাতে এলাকা ছাড়িতে বাধ্য হইল!


~ রেদ্ওয়ান আহমেদ

Comments

Popular Posts